আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে হয়েছে বিকশিত। জাতি আজ নিজস্ব চেতনার আলোকে বিশ্ব দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তৈরি হয়েছে স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে পাঁচ পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে সেই গৌরবগাথা। আজ ছাপা হলো দ্বিতীয় পর্ব।
সেটি ৪৭-র পর থেকেই আমরা চরম ভাবে অনুভব করতে শুরু করলাম। আমাদের শ্রমঘাম আর কষ্টে অর্জিত সম্পদ কেন্দ্রমুখী হতে শুরু করল। বিনিময়ে সকল ক্ষেত্রে ঠকবাজিতা, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতন, শিক্ষাদীক্ষায় অনুন্নতকরণ প্রচেষ্টা, আচার ব্যবহার দৃষ্টিভঙ্গি সকল ক্ষেত্রেই চরম বিমাতাসুলভ আচরণে অতিষ্ঠ করে তুলতে শুরু করল। আর, এই কাজে সামরিক শাসন ব্যবস্থা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সামাজিক ন্যায় বিচার তো দূরের কথা, বাংলার এই অংশের মানুষকে দাস কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার সকল ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। বাংলা ভাষাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে বাঙালি সত্ত্বার পরিচয়কে মুছে ফেলার জন্য উর্দু ভাষাকে বাধ্যতামূলক করবার ঘোষণা দিলেন আর বাংলা ভাষাকে উর্দু অক্ষরে লিখতে বললেন। তাদের ধূর্ততা খুব দ্রুত উপলব্ধি করে বাঙালি জাতি ১৯৫২ সালে মাতৃভাষাকে রক্ষা করলেন। এখানেই শেষ নয়, বরং বাঙালির ভাষাভিত্তিক এ চেতনার জাগ্রত রূপ বাঙালিকে সম্মুখপানে হাঁটতে তাড়িত করলো। এক কথায় রাজনৈতিক ভাবধারায় স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্বাধীনতার ভাবনাতে গতি সঞ্চার করতে থাকল।
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সকল ধর্মবর্ণ জাতপাতকে একই চেতনায় একীভূত করে একই সংস্কৃতির ছায়াতলে সকল ধর্মকে সমমর্যাদা দান করে সহ-অবস্থান করবার নিমিত্তে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযোজন করে ৬৬-র ৬ দফা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা একান্ত করে ভাবলে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে ফেললেন। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সমগ্র পাকিস্তানের শাসনভারে পরিবর্তন আনতেই ক্ষমতার পালাবদল না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং হীনমন্য রাজনীতিবিদগণের স্বেচ্ছাচারিতা অন্যায় আচরণের শিকার হয়ে জেল জুলুম নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেশ খানিকটা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত করা বাঙালি জাতিকে ৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার সর্বদিক নির্দেশিত ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি জাতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে অর্জিত হলো আমাদের স্বাধীনতা।
রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের খুব সুনির্দিষ্ট করে জাতীয়তাবাদের অহংকার না থাকায় তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণগুলোকে যথাযথভাবে গবেষণা ও উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের চৈতন্য জাগ্রত করে এবং তা একীভূত করে পূর্ব বাংলার সমগ্র মানুষের আস্থায় একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান ও বিশ্বাস দৃঢ়তার সঙ্গে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে রাজনীতিতে অন্যান্য শাখা প্রশাখা ভিন্ন মতাবলম্বী থাকলেও কেবল বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই এ বাংলার আপামর মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এক সাগর রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছে তার স্বপ্নের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বদরবারে বাঙালিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানীত করে আমাদেরকে বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সংক্ষেপে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ পরবর্তীতে সংবিধানের চারটি মুলনীতিতে একীভূত হয়েছে।
সমালোচনার ঊর্ধ্বে না হলেও এ কথা খুব স্পষ্ট করে বলতে কোন দ্বিধা নাই যে, ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যা একটি সফল নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বর্তমান ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোন নেতা তার দেশের নাগরিকদেরকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান এনে দিতে পারেননি। এ বিবেচনায় সফলতার মাপকাঠিতে সমগ্র ভারতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য কোনো নেতা আসেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক।
স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নসহ নাগরিক জীবনে মৌলিক প্রয়োজনসমূহের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় গৃহীত পদক্ষেপ, দারিদ্রতা দূরীকরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা, অর্থনীতির গতি সঞ্চালনে গৃহীত পদক্ষেপ, রাষ্ট্র পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ সঞ্চালন ব্যবস্থায় নীতি প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্টীকরণ, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি আদয়ে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে জ্যোতি ছড়ানোসহ ভবিষ্যৎ সাক্ষাৎ সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে সকল দিক নির্দেশনা, নীতি কৌশল, বিধি-বিধান প্রয়োজন, তার বেশির ভাগটাই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। সময় স্বল্পতার বিচারে গৃহীত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেও তাঁর ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থের সৌন্দর্য্য এত স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিকশিত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে নৃশংসভাবে হত্যা করা এবং ৩রা নভেম্বরে চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যার মধ্য দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ সংস্কৃতির সৌন্দর্যের নির্যাস বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা নরনারীর রক্ত মূল্যে অর্জিত কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার মূল চেতনাকেই কার্যত হত্যা করা হয়েছিল।
এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির পেশা এবং সাধারণ মানুষের মুক্তি কামনায় যেমন ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি করে বঙ্গবন্ধু পরিণতি হিসেবে ধরেই নিয়েছিলেন যে কোনো সময়ে তাঁর মৃত্যু কিংবা কারা ভোগ অনিবার্য হতে পারে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই মূলত স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক দলিল। সে আশঙ্কাই সত্যি হলো। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কাল রাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি কারাগারে আটক করল সামরিক শাসকগোষ্ঠী। মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা নিয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টা বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছিল পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর উপস্থিত থাকা এবং না থাকাকে কেন্দ্র করে দুটি প্রাসঙ্গিক গবেষণাধর্মী মন্তব্য করা যেতেই পারে। একটি বড় ভালো দিক উল্লেখ করার মতো, তা হল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ এই মহান নেতার প্রতি আস্থা রেখে শেষ অবধি দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিপরীতে আরেকটি আশঙ্কার বিষয় এভাবে দেখা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ব্লকের রাজনীতিবিদ কিছু কিছু সংস্থা সরকারি চাকরিজীবী এবং পাকিস্তানি জান্তাদের সহযোগিতাকারী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের মননে যে মরীচিকা সে সময় মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল, তার অনিবার্য পরিণতি হতে পারতো ৩০ লক্ষ আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতির সঙ্গে তুলনীয় এবং পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই আশঙ্কাটা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নাও হতে পারতো। বিশেষ করে ক্ষমতালিপ্সু কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণু নেতাকর্মীরা স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাবার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই যে মনস্তত্ত্ব ধারণ করেছিলেন, তা ছিল পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষাকে এই সকল তথাকথিত নেতাকর্মীরা পরিবর্তন করতে সক্ষম হননি বলেই না পেরে একান্ত বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কৌশলে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচল আস্থার কারণে তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ৭ই মার্চের ছড়িয়ে দেওয়া মুক্তিতরঙ্গ থেকে এ সকল তথাকথিত উশৃঙ্খল বাম ডান রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে তাদের পক্ষে টানতে সক্ষম হননি। জীবিত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা উত্তর ফিরে আসবেন কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন না বলেই স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বেই রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি তাদের লোভ লালসা আকাক্সক্ষা ও ষড়যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তাকে শান দিতে শুরু করেন। [চলবে]
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL