আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে হয়েছে বিকশিত। জাতি আজ নিজস্ব চেতনার আলোকে বিশ^ দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তৈরি হয়েছে স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে পাঁচ পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে সেই গৌরবগাথা। আজ ছাপা হলো তৃতীয় পর্ব।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, কারাগারে বসে এসবের প্রকৃত ধারণা বঙ্গবন্ধুর লাভ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুতেই ক্ষমতার ভাগীদার হতে না পারায় অনেকেই শুরু করে দিলেন তাদের ষড়যন্ত্রতত্ত্বের চর্চা। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আর বন্ধুমনোভাবাপন্ন দুই একটি দেশ ছাড়া খোদ আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপরিচালনাকে অকার্যকর করবার জন্য হেন কোন কাজ নাই যা তারা করেননি।
সমস্ত প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ১৭৬টি দেশের সমর্থন আদায় করা, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য পদ লাভ করা এমনকি বিশ্ব ব্যবস্থায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থনে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জ্যোতি ছড়াতে শুরু করলেন, তখনই চূড়ান্ত ঈর্ষণীয় হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। এ অবস্থায় শত্রুপক্ষ সকলে মিলে পরিকল্পিত সময় থেকে মিশন বাস্তবায়নে সময়কে সীমিত করে নিয়ে এসে মাত্র সাড়ে তিন বছরের চলমান শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটালেন বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের সকল সদস্যদের নৃশংস ভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। যদি বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সকল তথ্য পেয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মোটিভ আমলে নিতে পারতেন, তাহলে তাঁর সরল বিশ্বাসের জায়গায় কিছু পরিবর্তন এনে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে হয়তো এত দ্রুত আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারাতাম না। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন- এমন বাস্তবতা আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় উপলব্ধি করতে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম। বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশ পশ্চাদগামী হতে শুরু করল, তা যেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার মধ্যেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।
এর মাধ্যমেই শুরু হলো বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বলা যায়, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন সেই ঘৃণিত হত্যাযজ্ঞের শেষ অংকের পূর্ণতা দিতে। সংবিধানকে কাটাছিঁড়া করে এমনকি সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনায় মত্ত হলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে ইনডেমিটি পাস করলেন আর নতুন করে বাঙালি জাতির পরিচয়কে পুরাতন মোড়কে নিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কি এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ? সহজ করে বললে, ১৯৭২ সালের প্রতিবিপ্লবীদের আকাক্সক্ষা তথা আওয়ামী রাজনীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হতে শুরু করলেন, তাদের রচিত ক্ষেত্রকে বিবেচনায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে ঘুরেফিরে পাকিস্তানপন্থী জাতীয়তাবাদের মোড়ক উন্মোচন করলেন। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিবিপ্লবী ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে নিজের চিরাচরিত বিশ্বাসকে প্রতিস্থাপন করে তৎকালীন জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন একটি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিলেন। আওয়ামী লীগের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত আর তথাকথিত বাম রাজনীতির সমর্থকেরা ধর্মীয় রাজনীতির সমার্থক হিসেবে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ক্ষমতার লোভে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শের আওয়ামী লীগকে সেই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল চেতনাকে চিরতরে মুছে দিয়ে ধর্মীয় ভাবধারার পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের উত্থান হলো জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। মৃত্যু হলো আবহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সেই সাথে বিলুপ্ত হলো মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন তথা সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার সৌন্দর্যের বিকাশ। পরবর্তীতে সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একই ধারাবাহিকতার অনুসারী জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হলেন। তিনিও সংবিধানের তোয়াক্কা না করে উপর্যপুরী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্জিত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত না করে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জুড়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে জিয়াউর রহমান যে সুযোগটুকু জীবদ্দশায় পাননি তা সম্পূর্ণ করলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরুদ্ধ এমন সংস্কৃতিতে প্রায় ২১ বছর পথ হেঁটেছে। ফলে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে যে বিপরীত জ্ঞান লব্ধ করেছে, এই শাসন আমলগুলোতে তা আজকের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে রীতিমতো প্রগতির বিরুদ্ধচারণে এতটাই সক্রিয় যে বাঙালি সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতির চর্চা শিল্প সাহিত্যের বিকাশ কিংবা বাঙালিয়ানার বিরুদ্ধে ধর্মের দোহাইকে এমন করে শক্ত প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনার সময়েও তারা ইতিহাসের এ শৈল্পিক শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ধর্মীয় মানসে ভেঙে ফেলতে এতোটুকু পিছুপা হচ্ছে না বরং স্পর্ধার সাথে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে! অবশ্য বলে রাখা প্রয়োজন জিয়াউর রহমান পরবর্তী তার ঘর থেকে মনোনীত খালেদা জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির যে উত্থান হয়েছিল দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিল কুখ্যাত রাজাকার আল বদরদের মন্ত্রী বানিয়ে। সে সময়ে জামায়েত ইসলাম যে ক্ষেত্র রচনা করেছিল, তার ধারাবাহিকতা আজকের এই চ্যালেঞ্জের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। মজার ব্যাপার হলো জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে সেই সকল লোকজনের মহাসমাবেশ ঘটেছিল, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব কে চ্যালেঞ্জ করেছিল, ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করেছিল। আরও ছিল রাজনৈতিক কপটতায় বিশ্বাসী তথাকথিত বাম দলের নেতৃবর্গের সাথে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগের দোসর সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। রাতারাতি তথাকথিত সুবিধাবঞ্চিত বুদ্ধিজীবী পত্রিকার সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকেও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে সানন্দে যোগদান করতে দেখা গিয়েছে। আর জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি করেছেন তাদেরকে নিয়ে, যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে রাজনৈতিকভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যু-উত্তর জিয়াউর রহমানের দলে থাকা পূর্বের সুবিধাবাদী সেই চিহ্নিত মানুষগুলো। দীর্ঘ ৮/৯ বছর এরশাদের সামরিক শাসনকালে এদেরকে সুবিধা প্রদান করে এবং এদের পরামর্শক্রমে এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারপার্সন হয়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশ তার পথ চলার শুরুতেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হারিয়ে তার স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ঘটনায় পরবর্তীতে দেশের স্বাভাবিক পথচলা নিশ্চিত ভাবেই চরম আকারে বিঘ্নিত হয়েছিল। ভাবতে দ্বিধা নেই যে, এ ধারণাটি সম্মোক পূর্ব উপলব্ধি করতঃ পরিকল্পিতভাবেই এই ঘটনা সম্পাদিত হয়েছে। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের অংশীদারিত্বের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে জিয়াউর রহমান কেন কুখ্যাত অপরাধী রাজাকার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করলেন এবং ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তিকে সমীহভরে কেনই বা নতুন করে রাজনীতি করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন? এমন কি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে যারা হত্যা করেছিল, সেই কুখ্যাত খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তা থেকে স্পষ্টই একথা বলতে কোন দ্বিধা থাকে না যে, এই হত্যাকান্ডে, হত্যা পরবর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন ও অংশগ্রহণ রয়েছে। [চলবে]
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL