০৪-ডিসেম্বর-২০২৪
০৪-ডিসেম্বর-২০২৪
Logo
কলাম

পর্ব-৪ : বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

দিন পরিবর্তন ডেস্ক

প্রকাশিতঃ ২০২৩-১২-২৯ ১৯:৩৯:০৬
...

আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে হয়েছে বিকশিত। জাতি আজ নিজস্ব চেতনার আলোকে বিশ^ দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তৈরি হয়েছে স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে পাঁচ পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে সেই গৌরবগাথা। আজ ছাপা হলো চতুর্থ পর্ব।
আরেকটি বিষয় যা এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা ও ভাবনাকে সমর্থন করে, তা হলো- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভাবধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অটুট না রেখে চূড়ান্ত ডানপন্থীদের সাথে এক আত্মায় রাজনীতি করার দর্শন জেনারেল জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেছিলেন। যদিও এ কথা সত্য যে, তার অহংকারের মুক্তিযুদ্ধকে লোভ-লালসা ক্ষমতার মোহে বিসর্জিত করে নিজের পরিচয়ের গর্বকে পদদলিত করে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন। মধ্য ডান-বাম সমন্বিত অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক চেতনাকে দলীয় চেতনার রুপ দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু করার সুযোগ ছিল তার কাছে। কিন্তু তা না করে তিনি মূলত তার নিজের মুক্তিযুদ্ধকালিন ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অবশ্য এটাই হবার কথা । সৎ নির্লোভ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা যেমন মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আবার বিপরীতে সুবিধাভোগী ক্ষমতালিপ্সু কিছু সুযোগ সন্ধানীরা গোয়েন্দা চরিত্র ধারণ করে উভয়ের হয়েই কাজ করেছেন। আন্দোলন সফল হলেও তারা ক্ষমতার অধিকারী হবেন আর বিফল হলেও তিনি পুরস্কৃত হবেন। প্রসঙ্গক্রমে যুদ্ধে নানান কৌশল অবলম্বন হতে দেখা যায়। যেমন-
পাকিস্তানিরা যদি সত্যি পরাজিত হয়, তবে পরিকল্পনা বি বাস্তবায়নে যাদেরকে এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে কাজ করানো সম্ভব হয়েছে এমন ভেবে যে, যদি সত্যিই পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে আর বাংলাদেশের জন্ম কে কোনভাবেই ঠেকানো না যায়, সেক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা যেন টেকসই হতে না পারে সে লক্ষ্যে ধূরন্দর পাকিস্তান নব্য বাংলাদেশের জন্ম উত্তর স্বাধীনতার সুফল গ্রহণে স্থায়িত্বতা অর্জন করতে যেন না পারে এবং পুনরায় দ্রুত আভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে পারে, সেই পরিকল্পনায় বুদ্ধিভিত্তিক বিবেচনাকে গ্রহণ করে এজেন্ট হিসেবে এমন বেশ কিছু সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোককে বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, তার মধ্যে এরকম জেনারেলদেরও হয়তো কেউ কেউ ছিলেন তা বলাই যায়। সাড়ে তিন বছরেই প্রভুর প্রতি নজিরবিহীন আস্থা ও বিশ্বাসের পরিচয় দিয়ে পশ্চিমা প্রভুদের নতুন করে সন্তুষ্টি অর্জন করলেন অনায়াসে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বিশ্বের যে সকল শত্রু শক্তি রয়েছে তাদের কাছেও অত্যন্ত যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়, যে সময়টুকু পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, সে সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধচারি এমন একটি রাজনৈতিক দলকে পরিপূর্ণরূপে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা হরণে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি যথাযথভাবে সম্পূর্ণ করলেন অত্যন্ত চতুরতার সাথে। বলে রাখা প্রয়োজন, জিয়াউর রহমান শাহ আজিজ কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন যে জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের সাফাই গেয়েছিল। সে একজন চিহ্নিত আলবদর রাজাকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করা এবং দেশের আপামর মানুষকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেবার সকল প্রচেষ্টা এবং জোর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার যে ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে তিনি দেখিয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেই একই পরিণতি তিনি ভোগ করলেন তার দেখানো পথেই তারই বিভাগের কিছু জুনিয়র অফিসারদের কৃত খুনের মতো জঘন্য অপরাধের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ন অবদান রাখা সহস্রাধিক সেনাকর্মকর্তা ও জুনিয়র সেনাদের হত্যা করা হয়েছে জেনারেল জিয়ার আমলে।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধ্যায় শেষ হতেই নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন জেনারেল এরশাদ। আবারও সামরিক শাসনের যাত্রাপালা শুরু হলো। পূর্ববর্তী সামরিক শাসকের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার লক্ষ্যে তিনিও জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিও তিনি পূর্ববর্তী জেনারেল কে সমর্থন করে অবসরপ্রাপ্ত কিছু সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ থেকে কিছু নেতা এবং বিএনপি থেকে কিছু নেতাকে দলে ভিড়িয়ে নানান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির জন্ম দিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সৌন্দর্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিরতরে বিদায় করবার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ সংবিধানকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে মূল সংবিধানের শুধু অবমাননাই করেননি বরং সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বকে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্বে পরিণত করার হীনচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে বিদায় করবার জন্য স্থায়ী বন্দোবস্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলার নীল নকশা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়ার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করলেন। তখনকার বাংলাদেশে জনসংখ্যার বেশিরভাগ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তিনি খুব চতুরতার সাথে রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম করে মুসলমানদেরকে যেমন বোকা বানিয়ে তাদের নেতা হবার চেষ্টা করেছিলেন, একই সঙ্গে পাকিস্তানের স্বার্থ হাসিলের কাজটিও করেছেন সমভাবে। কেননা জনসংখ্যার আধিক্য অনুযায়ী ইসলাম অনুসারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন যতটা বৃদ্ধি পাবে পক্ষান্তরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাতি গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমতে থাকবে এটি তিনি খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি থাকেন বা না থাকেন, তার পরবর্তীতে যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসুন না কেন ভোটের গণতন্ত্রকে মাথায় রেখে পরিপূর্ণরূপে পুরনো সংবিধানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না আর সেটা তিনি পূর্ণরূপে অনুধাবন করেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। যদিও রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম থাকবার অনিবার্যতা আছে বলে জোরালো কোনো অভিমত তুলে ধরা সম্ভব নয়। যখনই বিশেষ কোন ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সঙ্গত কারণেই সে রাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে একটি আঘাত অনুভূত হয়। খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে যা অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে চরমভাবে আঘাত করার সমতুল্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজেই শুধুমাত্র একটি ধর্মকে তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে অন্য ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করছেন, যৌক্তিক বিচারে সেটি বলা ভুল হবে না।
সাম্প্রদায়িক মনন, শোষণ, শাসন, অন্যায় অবিচার অনায্যতার বিরুদ্ধে সাম্যতা, সামাজিক সুবিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তার সমন্বিত নির্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধারণ করে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একই বাসনা অনুভব করে যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিলেন, তারই সুফল হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক,পরিপূরক এবং প্রগতিশীল। অপরদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণরূপে বিপরীতমুখী এবং চরিত্রে চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা বিদ্যমান।
৭৫ পরবর্তী সময়টা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামরিক শাসন অব্যাহত থাকায় জনমনে এক অনিশ্চিত আশঙ্কা তৈরি হতে থাকলো। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করলো মুক্তমনা ছাত্র, শিক্ষক, জনতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেত্রীবর্গ সকলেই। আওয়ামী লীগের কান্ডারী হিসেবে ইতোমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজের দলের নেতাকর্মীদেরকে বেশ খানিকটা গুছিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকি, জিয়াউর রহমান উত্তর বিএনপি’র রাজনীতিতে বেগম জিয়াও তার দলকে এরশাদ হটাও আন্দোলনে প্রস্তুতির কাজটি বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন করেছিলেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে কেউ কেউ সরাসরি আবার কেউ কেউ মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দিতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করায় ও সামরিক ক্ষমতা জেনারেল এরশাদের হাতে থাকায় স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। বলে রাখা প্রয়োজন সমন্বিত এই আন্দোলনে প্রধানতম নেতৃত্ব প্রদানকারী দল জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং যুগপথ অবলম্বন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সেই সাথে অন্যান্যদের সমর্থন। বাঙালির প্রতিটি বড় বড় অর্জনে রক্ত ঝরানোর ইতিহাস যেন খুব স্বাভাবিক চিত্র। আর ৯০’র এ গণ আন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি মোটেও। স্বৈরশাসকের অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা ও তার প্রয়োগে তেমন কোনো বাছবিচার ছিল না। ডঃ মিলন এবং মেহনতী বীর নূর হোসেনের রক্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকামি গণআন্দোলন সফল হয় স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। [চলবে]
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব