মোবারক হোসেন:
বেশ কয়েক দিন ধরে পোশাক শিল্পের প্রধান প্রাঙ্গণ গাজীপুর বেশ অস্থির। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিগত কয়েক দিন থেকে রাজপথে নেমেছেন শ্রমিকরা। অবরোধ হয়েছে, হামলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে বেশ কয়েক জনের। সব মিলিয়ে দেশের প্রধান রফতানি শিল্প তৈরি পোশাক খাতে চলছে অস্থিরতা।
শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে চার বছরের ব্যবধানে পোশাককর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে ন্যূনতম বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। ১লা ডিসেম্বর থেকে ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো কর্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরও শ্রমিকরা রাজপথে। তাদের মতে, এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে নতুন বেতন কাঠমো সন্তোষজনক নয়। আবার মালিক পক্ষও এই বেতন কাঠানো বাস্তবায়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। সব মিলে এই পরিস্থিতিতে পোশাকশিল্প বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।
পোশাক শিল্পের মালিকরা পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেন। সেই বৈদেশিক মুদ্রা দেশে অর্থনীতিসহ যাবতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখে; সেই অর্থে পোশাক শিল্পের মালিকরা জাতীয় গর্ব। কিন্তু যে কর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে এই শিল্পকে প্রাণবন্ত রেখেছেন, তাদের জীবনধারাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাভাবিক করবে কে? উত্তরে নিশ্চয় আসবে মালিক পক্ষের নাম। এর পাশাপাশি সরকারের দায়দায়িত্বও ব্যাপক। একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের কর্মীদের চার বছর ধরে বেতন বৃদ্ধি হয় না- এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এই দীর্ঘ সময়ে দ্রব্যমূল্য কোনো পর্যায়ে গেছে- এটাও চিন্তার বিষয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নামে। পোশাককর্মীদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে, একথা বললে অতি উক্তি হবে না। এই জন্য তাদের দাবিকে আগেই গ্রাহ্য করা উচিত ছিল। রাস্তায় নেমে, অবরোধ করে, ভাঙচুর করে জানান দেওয়ার কোনো প্রয়োজ ছিল না। কিন্তু পোশাককর্মীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাদের এ সময়ের দাবিগুলো গ্রাহ্য করা হয়নি। যার ফলে তারা রাস্তায় নামতে বাধ হয়েছেন।
কিন্তু আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে কী দেখব? তখন করোনাকাল। বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রাখতে গিয়ে যেমন দেশের পোশাক কারখানাগুলো সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বল্প সময়ের জন্য শিল্প এলাকাগুলোতেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এতেই তৈরি পোশাকসহ যাবতীয় পণ্য উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে বিদেশেও পণ্য বিক্রি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়ায় একের পর এক রফতানি আদেশ বাতিল হতে থাকে। দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় নেমে আসে স্থবিরতা। বিশ^বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা একেবারে নিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোয় কর্মীদের আনাগোনা নেমে আসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। রফতানি কমে যাওয়ায় অনেক কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে শুরু করেন। এক সময়ের সমৃদ্ধ পোশাকশিল্পকে দেখতে হয়েছে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়।
পোশাকশিল্পের এই যখন অবস্থা, তখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিদগ্ধ পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে আবারও কারখানাগুলো শত সমালোচনার মাঝে জেগে ওঠে। গ্রামে ফিরে যাওয়া কর্মীরা কারখানা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে করোনার জন্য জারি করা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আবারও দলে দলে ফিরতে শুরু করেন কর্মস্থলে। উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও আসে নতুন জোয়ার। বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশগুলো নতুন করে নবায়ন হতে শুরু করে। অথবা স্থগিত হওয়া আদেশগুলো পুনঃ নবায়ন করে আবার শুরু হয় কর্মপ্রক্রিয়া।
কোনো দেশের আমদানি সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে ওই দেশের অবকাঠামোসহ যাবতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হয়। এর ফলে প্রভাব পড়ে জিডিপি বা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সূচকে দেশ স্থান পায় অনন্য মাত্রায়। আর এই আমদানি সক্ষমতা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে রফতানি আয়ের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। আবার কোনো দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি পেলেই যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ হয়, তেমনই এরই ধারাবাহিকতায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে জোয়ার আসে।
দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। সব রফতানি পণ্যের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় এই তৈরি পোশাক খাত থেকে। সেই অর্থে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সবচেয়ে বড় ভূমিকা এই তৈরি পোশাক খাতের। সেই পোশাক খাতের নেতিবাচক চিত্র কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পোশাককর্মীদের ন্যায্যতা নিশ্চত করতে হবে । মালিক পক্ষকে ভাবতে হবে এই উন্নয়ন-পরিবারে শ্রমিকরাও অংশীদার। তাদেরও ক্ষুধা, তৃষ্ণা আছে। পরিবারপরিজনের মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। দিনরাত কাজ করে চলেন। তাদের বলিষ্ঠ হাতের শ্রমে গড়ে ওঠে পণ্য। যে পণ্য রফতানি করে আসে বৈদেশিক মুদ্রা। তাই মালিকদের বিদেশি আয়ের ওপর ভিত্তি করে তাদের পারিশ্রমিক নিশ্চিত করার কথা ভাবতে।
আর সরকারের উচিত মালিক ও শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। মালিকেরা যেমন মেধা ও শ্রম দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক
কর্মসংস্থান করেন, যার লাভালাভের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে, তারা যেন সংকটের মুখে না পড়েন। এজন্য অবশ্যই বিগত দিনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা নিরীক্ষণ করে শ্রমিকের পাশাপাশি তাদের স্বার্থের সুরক্ষা দিতে হবে। মালিক পক্ষকে সুরক্ষা না দিয়ে কোনো শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সারা বিশ্বে আলোচিত একটি নাম। মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা পোশাক এখন বিশে^র উন্নত দেশগুলোয় বড় বড় ব্র্যান্ডের শো-রুম থেকে বিক্রি হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের স্বনামে খ্যাত ব্র্যান্ডগুলো আমাদের তৈরি পোশাকের মূল ক্রেতা। পোশাকশিল্পের এই গৌরবজনক অধ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আশির দশকে যাত্রা শুরু করা এ শিল্প ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার মতো শিল্পে অগ্রসর দেশকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বের পোশাক রফতানিকারকদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নেয়। যার প্রথম স্থানে রয়েছে উদীয়মান শিল্পশক্তি চীন। যাত্রার এই দীর্ঘ সময়ে দেশে গড়ে উঠেছে এ শিল্পের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, সেই সঙ্গে আরো সুগঠিত হয়েছে পোশাককর্মীদের দক্ষ হাত। এই দুই মিলে দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে অর্জিত হয়েছে অবাক করা ঈর্ষণীয় সাফল্য। শত প্রতিকূলতার মাঝে এই সাফল্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে প্রসারিত করতে হবে উদারনৈতিক সহযোগিতার হাত।
পোশাকশিল্পকে এগিয়ে নিতে বহুমাত্রিক ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এখন এ খাতকে এগিয়ে নিতে হবে নানা সংকটের মাঝেও। স্মরণ রাখতে হবে, দেশের প্রধান রফতানি পণ্য পোশাকশিল্প। যেখাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ কর্মী। যার মধ্যে আবার ৬০ শতাংশই নারী। এসব কর্মীর আবার সিংহ ভাগই গ্রামীণ জনপদের অধিবাসী। যার কারণে এদের আয়-রোজগারের বড় একটা অংশ স্বজনদের হাতে গিয়ে এলাকার হাটবাজারে ব্যয় হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করে। এমন একটি বিস্তৃত খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকা জরুরি।
এ জন্য সরকারকে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষ উভয়ের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে চলমান সংকটের সমাধান উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক। এই শিল্পকে সংকটমুক্ত করতে হলে অবশ্যই যাবতীয় অস্থিরতা দূর করতে হবে। অচীরেই এর একটা সমাধান হওয়া উচিত।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL