২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
কলাম

অনিশ্চিত গন্তব্যে অভিবাসী নারীরা

দিন পরিবর্তন ডেস্ক

প্রকাশিতঃ ২০২৩-১১-২২ ১৭:৪৫:৪০
...

দেশে কর্ম-প্রত্যাশী মানুষের তুলনায় কর্মক্ষেত্রের পরিধি কম। দিন দিন বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কর্মের পরিসর সেই তুলনায় বাড়ছে না। ফলে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সর্ব শেষ সনদ নিয়ে বেরিয়েও উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা কর্মের সুযোগ না পেয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। এদের মধ্যে আবার একটা বড় অংশ নারী। উচ্চ শিক্ষিত নারীরা তো আছেনই, এর সঙ্গে আবার মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধবিত্ত নারীরা বেশি কর্ম-সংকটে ভুগছেন।
প্রতি বছর দেশ থেকে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নিম্ন মধবিত্ত নারী বিদেশমুখী হচ্ছেন। একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
গত ১ নভেম্বর সংসদ অধিবেশনের এক প্রশ্ন-উত্তর পর্বে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত পাঠানো নারীকর্মীর সংখ্যা ১১ লাখ ৬৬ হাজার ১৭৬ জন। বিদেশে নারীকর্মীর চাহিদা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, মরিশাস, লেবানন ও বাহারাইনের নাম আগে রয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক নারীকর্মীর এক অধ্যায় নিশ্চয় বিদেশি আয়ে একটি বড় বিষয়।
নিজ পরিবারে উপার্জনের সীমারেখা সীমিত হওয়ায় অনেক নারীকর্মী বিদেশমুখী হন। নানান প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পরিবারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে তাদের এই কর্ম প্রচেষ্টা। প্রতিটা নারীকর্মীকে ইজ্জত-সম্ভ্রম সঙ্গে নিয়ে অচেনা দেশে অচেনা পরিবারে রোজগারের আশায় সংযুক্ত হতে হয়। ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতা অনেক সময় এসব নারীকর্মীকে বিপর্যয়ে ফেলে। তার পরও সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাদের বিদেশে কাজ করতে হয়।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশ থেকে ফেরত আসা শতকরা ৮৫ ভাগ নারীকর্মী হতাশায় ভোগেন। কারণটা কী? পেছনের কারণ হিসেবে অনেক তথ্য উঠে এসেছে।
একটি জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে অন্য এক সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘প্রবাস ফেরত নারীকর্মীরা বিদেশে নির্যাতিত, দেশে কলঙ্কিত।’ খুবই গুরুত্ববহ শিরোনাম। চারটি শব্দে অভিবাসী নারীকর্মীদের দুটি চিত্র উঠে এসেছে। একটি বিদেশে কর্মকালীন সময়ের আর একটি দেশের কর্ম-পরবর্তী সময়ের। ওই জরিপ প্রতিবেদনে ৩৮ শতাংশ নারী দাবি করেছেন, তারা কর্মকালে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৫২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ৬১ শতাংশ নারী প্রবাসে থাকার সময় প্রায়ই খাবার ও পানির অভাবে কষ্ট পেয়েছেন। প্রবাসফেরত নারীকর্মীদের ৯০ শতাংশই মনে করেন, তাদের জন্য একটি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত।
বিদেশে লাঞ্ছনা সহ্য করে কর্মজীবন কাটিয়ে এসেও দেশে নানা কটু কথার বোঝা বহন করতে হয় তাদের।
কী ভয়াবহ চিত্র প্রবাসী নারীকর্মীদের। কোনো রকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া তাদের কাজ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে যারা নারী গৃহকর্মী, তাদের ঝুঁকিটা বেশি।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক কারা যায় প্রবাসে গৃহকর্মী হয়ে? জরিপ নিবন্ধে এক অংশে বলা হয়েছে, মূলত ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সি প্রবাসফেরত নারীদের এক-চতুর্থাংশ তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্ত। অর্ধেকেরও বেশির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তারাই মূলত জীবিকার তাগিদে বিদেশমুখী। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী যখন সব দিক থেকে অসহায় হয়ে পড়ে তখন ঝুঁকি নিয়ে বিদেশমুখী হন পারিবারিক স্বচ্ছলতা আনতে । আর তারাই নিগৃহীত হন বিভিন্নভাবে।
দেশের অন্য পেশার নারীকর্মীরাও বিদেশে যান কর্মমুখী হয়ে। বিশেষ করে ডাক্তার, নার্সরাও বিদেশে যান। তাদের পেশাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে হওয়ায় শোষিত ও নিগৃহিত হওয়ার ঝুঁকি কম।
আমাদের দেশে নারীকর্মী বা পুরুষকর্মী কারো জন্যই সন্তোষজনক নীতিমালা তৈরি করা হয়নি; যার ওপর ভিত্তি করে এ দেশের অভিবাসীকর্মীরা বিদেশে স্বাচ্ছন্দ্যে রোজগার করবেন।
একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী ইচ্ছে করলে বিদেশি এজেন্টদের চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো দেশে জনশক্তি রফতানি করতে পারেন। সেখানে কর্মপরিবেশ কেমন হবে, বেতন কত হবে, তার জন্য অন্যান্য সুবিধা কী, এসব তারাই মুখে মুখে জানিয়ে দেন। এটা নিশ্চিত করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কাছে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা নেই। যার কারণে বিদেশগামী কর্মীরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। শ্রমের ন্যায্য মজুরি, চাকরির নিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা - এসব যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যার ফলে প্রবাসীকর্মীদের বিদেশি আয়ের স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হচ্ছে।
একজন অভিবাসীকর্মী যদি তার কর্মস্থল থেকে শুরু করে মজুরি নেয়া পর্যন্ত স্বাভাবিকতা অর্জন করতে বাধাগ্রস্ত হন, তাহলে সেটা দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহকে অনিবার্যভাবে ব্যাহত করবে। আর যদি নীতিমালার মাধ্যমে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কর্তাব্যক্তিরা দেশে-বিদেশে সর্বত্রই সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। দেশে নারী অভিবাসীকর্মীদের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি।
যদিও সরকার পক্ষ বলে আসছে নারী শ্রমিকরা যেন কোনো বৈষম্যের শিকার না হয়, সেজন্য সর্বদা সরকারের নজরদারি ও উদ্যোগ অব্যাহত আছে। নারীকর্মীদের সুরক্ষায় সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান ও লেবাননে মোট ছয়টি সেফ জোন খোলা আছে। কিন্তু তার কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। ওই সব সহায়তা কেন্দ্রে কী পরিমাণ ভুক্তভোগী সহায়তা পেয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান জানার বাইরে।
নারীকর্মীরা যখন এ দেশের দালালদের মধ্যস্থতায় বিদেশে যান, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রম অধিকার, বেতনভাতা, খাওয়া-থাকার মান- এসব মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। যার ফলে দেখা যায় অনেক নারীকর্মী সবকিছু হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফেরেন। এমনকি অনেক নারীকর্মী বিদেশি গৃহকর্তার অবৈধ লালসার শিকার হয়ে অন্তঃসত্তা হয়ে দেশে ফেরেন। এবং পরে দেশি-বিদেশি নিয়োগসংক্রান্ত কাজে জড়িতদের আইনের মাধ্যমে শনাক্ত করা দুরুহ হয়ে পড়ে। ফলে অনেক নারীকর্মী দীর্ঘ সময় অভিবাসী হয়েও সুবিধা-বঞ্চিত হন; কোনো আর্থিক সুবিধা ছাড়াই দেশে ফেরেন। বাকি জীবন অর্থাভাবে দুর্বিসহ সময় অতিবাহিত করেন। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?
শুধু নারীকর্মী নয়, প্রতিটি অভিবাসীকর্মী যেন তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন, এজন্য দেশে একটা নীতিমালা তৈরি করা দরকার। যেন সুবিধভোগী গোষ্ঠি সরকারের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্মীকে বিদেশে নিয়ে যেতে না পারে। কিংবা বিদেশ যাওয়ার পরও যেন কর্মীদের সার্বিক অবস্থা সরকারের নিরীক্ষণে থাকে। এই নীতিমালার আওতায় থাকবে জনশক্তি রফতানিকারী দেশি এজেন্ট, বিদেশি এজেন্ট, বিদেশি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারের বিদেশি দূতাবাসসহ এ-সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা। এ জায়গাগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা না থাকলে কখনও প্রবাসী আয়ে স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ আসবে না। দেশের অর্থনীতিকে অধিক শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই অভিবাসীকর্মীদের অধিকারকে আইন সঙ্গতভাবে প্রাতিষ্ঠা করতে হবে। এজন্য চাই দূতাবাসগুলোর আরে াসক্রিয়তা। তা না হলে শ্রমজীবীরা বঞ্চিত হতে থাকবেন আর দেশ হারাতে থাকবে রেমিট্যান্স উপার্জনের সোনালি সুযোগ।
লেখক: সাংবাদিক