আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়েছে। বাংলাদেশ এ দফায় ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। ছয় মাস পর সংস্থাটি গত ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয়, ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে এ অর্থ। আইএমএফ পর্ষদ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করার দুদিন পর গত ২ ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার পায় বাংলাদেশ। আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করা হলে বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার চলতি মাসেই পাবে। গত ৩০ জানুয়ারি অনুমোদন হওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বিতীয় কিস্তিসহ ছয়টি কিস্তি সমান হারে দেবে আইএমএফ। ঋণের গড় সুদের হার ২.২ শতাংশ। ৪৭০ কোটি ডলারের মধ্যে দুই ধরনের ঋণ রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা এবং বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। রেজিলিয়্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামো আধুনিক করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজে এই ঋণ সাহায্য করবে। ঋণ কর্মসূচির আওতায় দেওয়া শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় অর্জন সম্ভব হয়নি। তবে অন্যান্য শর্তে কিছু অগ্রগতি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করায় দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিল সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ মিশন। আইএমএফের ঋণ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে চলতি মাসে আরো প্রায় ৮০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরে এসব সংস্থা ঋণ ছাড় করলে দেড় বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। এসব অর্থ যুক্ত হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়বে।
আইএমএফ এর বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দারুণ অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হয়েছিল। আইএমএফ এর একটি চৌকস দল তাদের বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদনের আগে এ সংক্রান্ত শর্তাবলী সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়েছে কি না তা যাচাই করতে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণে অনেকগুলো ঘাটতি, ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা হয়েছিল। বেঁধে দেয়া রিজার্ভ সঞ্চিতির পরিমাণ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, সরকারি ভর্তুকি কমানো, ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদ্যমান অনিয়ম দুর্নীতি দূরীকরণে সংস্কার কার্যক্রম শুরু, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ সুদহার নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সবকিছু পরিপালন পরিচালনা অনেক কঠিন। ফলে আইএমএফ এর শর্ত পূরণ অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তেমন অবস্থায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়ে দারুণ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিছুদিন আগে বেঁধে দেয়া শর্ত পরিপালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার ঋণের কিস্তি আটকে দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় শ্রীলঙ্কা নীতি সুদহার ১০০ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়ায় শ্রীলঙ্কাকে ঋণের কিস্তি আটকে দেয় সংস্থাটি। বাংলাদেশকেও কী শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে হয় ডশ না তা নিয়ে সংশয় ছিল। আমাদের সৌভাগ্য বলা যায়, বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থতা, অন্যান্য সীমাবদ্ধতা, ত্রুটিবিচ্যুতি গুলোর নেপথ্য কারণ সম্পর্কে তাদের বোঝানোর চেষ্টায় সফল হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকটা ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ঋণের শর্ত কিছুটা শিথিল করছে। ফলে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তি। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন কম। তবে আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণও থাকবে এ রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি। তারা বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দক্ষতা আনতে হবে খরচ করার ক্ষেত্রে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে চাপ পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপর, তা মোকাবিলায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, পুরো ব্যাংক খাতে তদারকব্যবস্থা বৃদ্ধি ও সুশাসনব্যবস্থা জোরদার করলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়নও জরুরি।
ঋণের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পূরণ হয়েছে। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও বৈশ্বিক যেসব কারণ আছে, সেগুলো আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন অনুমোদনের সময় আইএমএফ সময়ভিত্তিক কিছু লক্ষ্য দিয়েছিল বাংলাদেশকে। তবে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রিজার্ভ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়নি। তবে সরকারের দিক থেকে আইএমএফের দলকে শর্ত পূরণ করতে না পারার কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারিতে যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ফলে এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করার বাস্তবতা নেই। একটু কমিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত নতুন লক্ষ্যমাত্রা চাইলে আইএমএফ তাতে সম্মতি প্রকাশ করেছে। নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে ২ হাজার কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে প্রথম কিস্তির মূল্যায়ন করতেই আইএমএফের দল ঢাকায় এসেছিল। নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ রাখতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি এবং আগামী জুনের মধ্যে ২ হাজার কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী গত জুনেই বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বরের রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ডিসেম্বরে লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার।
স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে মুদ্রানীতির রাশ টেনে ধরার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এর সঙ্গে সহায়ক নীতি হিসেবে নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি ও মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে আরও নমনীয় হওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি। বাইরের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে এসব পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। মুদ্রানীতির কাঠামো আরও আধুনিকায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আইএমএফ। মুদ্রানীতি আধুনিক হলে তার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির প্রভাব জোরদার হবে। মুদ্রার একক বিনিময় হার গ্রহণের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আরও নমনীয় হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। তারা মনে করে, অর্থনীতির বহিস্থ ধাক্কা মোকাবিলায় এটি জরুরি। বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের পর দেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন করে সংস্থাটি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে তারা এসব কথা বলেছে। বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ)-এ তিনটি ভাগে ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। এবার ইসিএফ বা ইএফএফের আওতায় ৪৬ কোটি ৮৩ লাখ ডলার এবং আরএসএফের আওতায় ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলার সব মিলিয়ে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে আইএমএফ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আর্টিকেল ৪ শীর্ষক পরামর্শ সম্পন্ন করেছে আইএমএফ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমতির দিকে থাকলেও রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। কঠোর মুদ্রানীতি ও নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতির কল্যাণে মূল্যস্ফীতির হার আগামী অর্থবছরের শেষ নাগাদ ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে। আইএমএফ মনে করে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ জরুরি। করনীতি সংশোধন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কর-রাজস্ব বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে সংস্থাটি। ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয় করার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরও দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্ব দিয়েছে তারা। উন্নয়নের জন্য দেশে অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ বাস্তবতায় আইএমএফ মনে করে, আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি পুঁজি পুনরুদ্ধারে বিশেষ কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। পরিচালকেরা এ বিষয়ে একমত যে ব্যাংক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করা, শাসনব্যবস্থার উন্নতি ও দেশীয় পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন; সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার তাগিদ দিয়েছে তারা। সংস্থাটি মনে করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা ব্যবস্থা উন্নত হলে, তা আর্থিক খাতের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের তহবিলও পাওয়া যাবে। দেশের অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই নানাবিধ সংস্কার প্রয়োজন- উচ্চমাধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছাতে গেলে এসব জরুরি বলে মনে করে আইএমএফ। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে শ্রমশক্তিতে বাণিজ্য উদারীকরণ, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী বাহ্যিক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইএমএফের পরিচালকেরা মনে করেন, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সংস্থাটির শর্ত পরিপালনে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে পথচ্যুত হয়নি। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ যেসব সংশোধনমূলক ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে ও জরুরি সংস্কার বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে বহুপক্ষীয় এ সংস্থাটি। আইএমএফের পরিচালকেরা মনে করেন, স্বল্পমেয়াদি নীতি প্রণয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতির রাশ টানা এবং বহিস্থ ধাক্কা মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি। সেটা করার ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর যেন তার প্রভাব না পড়ে। শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার গুরুত্ব তুলে ধরেছে আইএমএফ। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী ধারা বজায় রাখতে বাংলাদেশের দ্রুত ও সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জে রয়েছে। এক বছর ধরে অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ পড়েছে, যা রিজার্ভ কমিয়েছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। একই সময়ে একাধিক বিনিময় হার, সুদের হারের সীমা ঠিক করে দেওয়া, ব্যাংক খাতে অপর্যাপ্ত তদারকি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে, যা এ দেশের বহু পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তায় বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অবশ্য নির্বাচনের বছরে এমন চিত্র অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া জ্বালানির উচ্চমূল্য, কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্পোৎপাদন কমেছে। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু স্বল্প মেয়াদি সংস্কার লাগবে। যেমন, নমনীয় বিনিময় হার প্রবাসী শ্রমিকদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোয় সহায়তা করবে, আবার প্রবাসী আয়ও বাড়বে। এ ছাড়া সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া ও মুদ্রানীতি শক্তিশালী করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক খাতের সংস্কারে ব্যাংক খাতে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। সম্প্রতি মুদ্রানীতিতে কিছু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের গতি দ্রুত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত একক পণ্যের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। তাই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কারণ, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির নতুন নতুন চালিকা শক্তি লাগবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর বিনিয়োগ আনতে হবে। এ জন্য আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শেয়ারবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের উৎস হিসেবে পরিণত করা উচিত। তৃতীয়ত, যানজট ও পরিবেশের দুর্বল পরিস্থিতির কারণে নগরায়ণের সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া অবকাঠামো দুর্বলতা ও মানবসম্পদ নিম্নমানের কারণে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া শোভন কর্মসংস্থান তৈরি, লিঙ্গবৈষম্য কমানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এসব বিষয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে পড়লেও আমরা বেশ আশাবাদী। কারণ, এ দেশের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। যেমন, জনসংখ্যা বোনাস, তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিশাল প্রবাসী গোষ্ঠী ইত্যাদি। সময়মতো সঠিক নীতি সংস্কার করতে পারলে আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কোভিডের মধ্যেও আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো করেছি। সারা বিশ্বেই এখন অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চ্যালেঞ্জ আছে। ব্যাংক খাত ঝুঁকিতে থাকলে পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়ে। এই খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা উচিত।
আগামি ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে আইএমএফ এর বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া নিয়ে একধরনের সংশয়, আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়ে চারপাশে নানা গুজব, গুঞ্জন ছড়িয়েছিল একটি মহল। বর্তমান বিদ্যমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আইএমএফ এর বরাদ্দকৃত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। তখন বর্তমান সরকার চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। তা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া দুস্কর হয়ে উঠবে। এ ধরনের কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলো। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের এক অনন্য সাফল্য অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা যায় এটাকে। সকল ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় তা মোকাবেলা করে সবকিছু সামাল দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার। কোনোভাবেই তাকে দমিয়ে রেখে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, প্রগতি- মোটকথা বাংলাদেশের এগিয়ে চলা রোধ করা যাবে না। এটা আরেকবার উজ্জ্বলভাবে প্রমাণিত হলো।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL