নানা পেশার মানুষের জীবনধারায় বৈচিত্র্যময় আমাদের সমাজ। বিচিত্র পেশায় সুসজ্জিত সমাজ অনন্য করেছে বাংলাকে। গ্রামবাংলার রূপে রঙে পেশাজীবী মানুষেরা মিশে আছে প্রকৃতির অঙ্গ হয়ে। এরা যুগ যুগ ধরে আবহমান বাংলাকে শোভিত করেছে অপার সৌন্দর্যে।
আমাদের দেশে জীবন বৈচিত্র্যের আধার ভিন্ন ভিন্ন পেশা সৃষ্টি হয়েছে সেই কবে থেকে, কেউ তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না। বলা যেতে পারে, মানুষের প্রয়োজন থেকে পেশার সৃষ্টি হয়েছে সেই আদিকাল থেকে।
একসময় গ্রামে গ্রামে লাল করে পোড়ানো মাটির হাঁড়ি নিয়ে আসতো কুমাররা। স্টিলের বাসন-কোসনের প্রচলন হওয়ার ফলে সেসব আজ বিলুপ্তির পথে। এখন তারা আর গ্রামে গ্রামে আগের মতো খুব একটা যান না।
বাঁশ ও বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন যারা, তাদের পেশারও একই হাল। তারাও যেন সংকটপূর্ণ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ভিন্নতার সন্ধানে। বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রের জায়গায় এখন দখল করে নিচ্ছে রংবেরঙের প্লাস্টিক সামগ্রী। এসব শিল্পসামগ্রীর মূল্যেও কম, আবার দেখতেও ভালো। এ কারণে মানুষ এসব পণ্যের দিকে ঝুঁকছে বেশি।
আগে গ্রামের গৃহস্থবাড়িগুলোতে বছরচুক্তিতে সেবা দিয়ে যেতো কামার সম্প্রদায়। তারা লাঙলের ফলাকে ধারালো করতেন বছরভিত্তিক চুক্তিতে। হাঁসুয়া, বঁটি, দা, কুড়াল এসব সংসারী জিনিসে ধার দিতেন বছরজুড়ে। বছর শেষে অগ্রহায়ণ মাসে তারা চুক্তির ধান নিয়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, মুচি সম্প্রদায়ও বছরচুক্তিতে গৃহস্থবাড়িতে কাজ করতো। তারা সারা বছর জুতা-স্যান্ডেল মেরামত করতেন বছরচুক্তির শর্তে। এভাবে অনেক পেশা টিকে ছিল গ্রামীণ জীবনের আবহে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে।
বিচ্ছিন্নভাবে তাঁতি সম্প্রদায়ের একটা অবস্থান ছিল দেশের অনেক এলাকায়। মাক্কু চালনার খটাস খটাস শব্দে একসময় ঘুম ভাঙতো গ্রাম্য জীবনের অনেক প্রতিবেশীর। সুতা ও রঙের দামের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য লুঙ্গি, শাড়ি ও গামছার বিক্রয় মূল্যের সমন্বয় না থাকায় পেশা পরিবর্তন করে অনেকে চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়। যদিও এলাকা ভিত্তিকভাবে অনেক তাঁতি টিকে আছেন ঋণচক্রে আবদ্ধ হয়ে। এরা সবাই আবেগী মায়ায় আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পেশা।
নাপিতরাও গৃহস্থবাড়িতে বছরচুক্তির কাজ করতেন। সারা বছর পরিবারের বুড়ো, যুবক, শিশু সবার চুল ছাঁটতেন। এসব আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে নিয়তির বেঁধে দেয়া নিয়মে।
যুগের হাওয়ায় সমাজ বিবর্তনে, আধুনিকতার কৃত্রিম জীবনের দাপটে, ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এদের পেশা। ম্রিয়মাণ স্বপ্নের ক্ষীণ আলোকরেখায় ধিকি ধিকি বেঁচে থাকা এসব মানুষ কোনো রকমে চালিয়ে নিচ্ছে জীবন। এ প্রান্তজনেরা জাতীয় অর্থনীতিতে না রাখতে পারছে অবদান, না পাচ্ছে জীবনে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়া ।
কয়েক বছর আগে আগে রাজধানীর শেরেবাংলানগরে এনইসি সম্মেলেন কক্ষে জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এক বৈঠক হয়েছিল। বৈঠক শেষে এমনই একটি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তিনি পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বলেছিলেন, অর্থনীতির মূলধারায় আনতে নয়টি পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বেদে, কামার, কুমার, জেলে, স্বর্ণকার, বাঁশ-বেতের সামগ্রী প্রস্তুতকারক, কাঠমিস্ত্রি, মিষ্টি প্রস্তুতকারক ও নাপিতকে। এসব পেশার সেই সময়ের ৫২ লাখ মানুষের জন্য ১২০০ থেকে ১৫০০ প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। একটি জাতীয় দৈনিকের শেষের পাতায় এ সংবাদ ছাপা হয়েছিল।
দেশ চলে গতানুগতিকতার পথে। সরকার আসে, সরকার যায়। সময় বয়ে চলে নিয়মের হাত ধরে। সামাজিক উত্থান-পতনে পেশাজীবীরা নানা ঘাত-প্রতিঘাতে থমকে দাঁড়ায়। কখনও-বা থেমে থেমে পথ চলেন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য নিয়ে। কিন্তু প্রান্তজনের পেশামুখী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই।
জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে পেশাজীবীদের ভূমিকা থাকেই। সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি সমাজ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এরা পিছিয়ে থাকলে দেশের অর্থনীতি পিছিয়ে যায়। আর এগোলে জাতীয় অর্থনীতি বেগবান হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জিডিপির ক্ষেত্রে এসব জনগোষ্ঠীর সূচককে তীক্ষè নজরে রাখে। ঠিক মতো সব শ্রেণী-পেশা এগোচ্ছে কি না, নজর দেয়ার মতো কোনো বড় ধরনের সংকট চলছে কি না- এসবই তাদের নজরের আওতায় থাকে।
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে পেশাজীবীদের উন্নয়ন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। বিশে^র উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে দাঁড়াতে হলে বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-মান অবশ্যই উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হবে।
সরকার নয়টি পেশার মানুষের উন্নয়নে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে- এ দাবি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন করে আসছিল। পেশাজীবীদের নিয়ে ৫০০ আসনের সংসদীয় প্রতিনিধিও দাবি করা হয়েছিল; যা এত দিন ছিল রাজনৈতিক বুলি হিসেবে, আজ তা আংশিক হলেও বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। সংসদীয় প্রতিনিধি না হোক, পেশাজীবী উন্নয়নের যে পদক্ষেপ তা ছিল দীর্ঘ সময়ের জনদাবি।
বৈশি^ক পরিধিতে দেশের অবস্থান শক্ত করতে আজ সেটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ পিছিয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণে সরকার যে সব প্রকল্প তা সর্ব মহলে প্রশংসিত হবে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, এ প্রকল্পগুলো যেন কোনো ভাবেই জটিলতায় আটকে না যায়।
যেকোনো শুভ উদ্যোগের আলোচনা-সমালোচনা যেমন আছে তেমনই আছে নানা বাধা-বিপত্তি। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নেও নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোনো বড় উদ্যোগের বাস্তবায়ন একটি সরকারের অন্যতম সাফল্য। তৃণমূলের মানুষের মনে স্বস্তি আনার মতো কোনো প্রকল্পের গতি যেন মাঝ পথে থমকে না যায়- এটা সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ প্রকল্প যেকোনো মূল্যে সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের প্রকল্প নিম্নবিত্ত সমাজে পরিবর্তন আনতে নিপুণ হাতিয়ার হতে পারে।
একাধিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যদি যুগের পর যুগ পিছিয়ে থাকে, তাহলে দেশের উন্নয়ন সঠিক গতিতে হতে পারে না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনাচার লক্ষ্য করলে সেটাই স্পষ্ট হয়।
পেশাজীবীদের নিয়ে উন্নয়ন-পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে যুগের মাইলফলক হয়ে থাকবে, যদি সরকার তা পুরোপুরি বাস্তবায়নে সফল হয়। অনেক প্রকল্প সঠিক তদারকির অভাবে মাঝপথে থমকে যায়। প্রকল্প বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।
যেসব অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবন-মান নিয়ে এ প্রকল্প, তাদের নিয়ে কোনো অতীত সরকার এরকম বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই। আশা করি, এসব প্রকল্প আলোর মুখ দেখে পৌঁছে যাবে সেসব বঞ্চিত মানুষের দ্বারে- এ কামনা সবার।
লেখক: সাংবাদিক
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL