২৩-নভেম্বর-২০২৪
২৩-নভেম্বর-২০২৪
Logo
কলাম

চিত্র-সাংবাদিকতা: এক ছবিতে হাজার কথা

দিন পরিবর্তন ডেস্ক

প্রকাশিতঃ ২০২৩-১২-২৬ ১৮:৪৩:৫০
...

একটি ছবি হাজার শব্দের পরিব্যাপ্তি। অর্থাৎ এক হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদনে যা ব্যক্ত করা যায় না, একটি মানসম্পন্ন বিষয়কেন্দ্রিক ছবি তার চেয়ে ব্যাপক বিস্তৃতির ব্যক্ত-ক্ষমতা রাখে। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এক হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন যতটা না পাঠককে আকর্ষণ করতে পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি একটি অর্থবহ ছবি পাঠকের ভাবনার নদীতে ঢেউ ভাঙে। গণমাধ্যমজগতে এমনই একটি তত্ত্ব-চিন্তা বহু আগে থেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রখর অনুভূতির প্রবীণ গণমাধ্যমবিদরা এ প্রয়োজনীয় তত্ত্বটি সংবাদপত্রে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। ছবিকে আন্তর্জাতিক ভাষাও বলা হয়। কারণ একটি অর্থবহ ছবি ক্যাপশন ছাড়াও পৃথীবির সব ভাষার মানুষ অনুধাবন করতে পারে।


যে ছবি প্রথম দর্শনে দৃষ্টি কাড়ে, মানুষকে আবেগী করে, বিশ্লেষণী চেতনায় তাড়না জায়গা, কিংবা ক্ষণিকের দৃষ্টিপাতে পাঠককে উদাস করে দেয়- বলা যায়, চিত্র-সাংবাদিকতা এরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এখন সংবাদপত্রে অনেক বিভাগের মধ্যে ‘ফটো সেকশন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব দৈনিকে চিত্র-সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত বিভাগ হিসেবে নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু এর যথাযর্থ ব্যবহার কতটা হচ্ছে- সেটা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। ফটো সেকশন আছে কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এর যথাযথ ব্যবহারের অবনমন হয়েছে- এমনটা ভাবলে চিন্তার আঁকাবাঁকা রেখাগুলো উঁকি-ঝুঁকি মেরে সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। অসঙ্গতির জিজ্ঞাসা চিহ্নগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- ‘ওই ছবিটা তো এমন হওয়া উচিত ছিল।’


সংবাদপত্রে ছবি তোলার কার্যটির কৌতূহলী যাত্রাকে যারা শখের বসে সত্তায় ধারণ করেছেন, পরবর্তীকালে তাদের অনেকেই এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন- এ সত্য অস্বীকার করার নয়। দামি একটা বড় ক্যামেরা তাক করে ফ্লাসলাইটের চোখ ধাঁধানো আলো ছড়িয়ে মুহূর্তেই সমবেত জনতাকে হকচকিয়ে ছবি তোলা সহজ মনে হলেও আসলে এটা সহজ কোনো কাজ নয়, সহজ কোনো পেশাও নয়- এলাম আর ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে চলে গেলাম- এটাই চিত্র-সাংবাদিকতার শেষ কথা নয়। ছবি ধারণ করতে চিত্র-সাংবাদিকের থাকা চাই বিষয়-বিবেচনার গভীর অনুভূতি, যার অনুভবে সাড়া ফেলে ছবিটি ক্যামেরায় লেন্সে ধরা পড়বে- পাঠকের ভালো লাগার লক্ষ্য হিসেবে। এ কারণে বলতে হচ্ছে- এই ছবি তোলা পেশার আনুভূতিক ছবি ও দৃষ্টিভঙ্গিগত আত্ম-উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবি-লেখক যেমন স্বল্পশব্দে কথার ভাঁজে ভাঁজে জীবনজগতের ছবি সাজিয়ে তুলেন গল্প কিংবা কবিতার পরতে পরতে, তেমন দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার হওয়ার দরকার একজন চিত্র-সাংবাদিকের। ধারণ করা একটি ছবি প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে আপন স্থান করে নেবে সংবাদপত্রের পাতায়। পাঠককে প্রথম দৃষ্টিপাতে টেনে নিয়ে আসবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। পাঠক বারবার পরখ করবে ছবির মায়াময়ী বিষয়বস্তু। পাঠককে প্রকাশিত ছবি চমকিত করলে পাঠক অনুরূপ আরো ছবির প্রত্যাশায় ওই সংবাদপত্রের আগামীর সংখ্যাগুলোয় বারবার ঢুঁ মারবে, প্রত্যাশিত ছবির আকর্ষণে। এভাবে ভালো ছবির ভূমিকা সংবাদপত্রে অনন্য হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক সংবাদপত্রে এ বিষয়টি উপেক্ষিত হতে শুরু করেছে। হতে পারে সংবাদপত্রে দায়িত্ব প্রাপ্তরা বিষয়টিতে নজর দেয়ারই সময় পাচ্ছেন না। কিংবা বহু-ব্যস্ততায় হারিয়ে যাচ্ছে এর গুরুত্ব। প্রসঙ্গের স্বার্থে এখানে একটি বিষয় বলা খুবই আবশ্যকীয়। আগে অনেক পত্রিকায় অনেক চিত্র-সাংবাদিক ছিলেন, যাদের লেখাপড়ার গণ্ডি একেবারে প্রাথমিক স্তরের শ্রেণিভুক্ত। শোনা যায়, তারা কি না ছবির ক্যাপশন পর্যন্ত লিখতে পারতেন না। তোলা ছবি দেখিয়ে ফটো-এডিটরকে মুখে বর্ণনা দিয়ে ছবির বিষয়বস্তু বোঝাতে হতো। তাদের এক সময় সংবাদপত্র জগতে ‘ফটোগ্রাফার’ হিসেবে ডাকা হতো। কিন্তু সেদিন আর নেই। এখন ফটো-জানালিস্ট হিসেবে এই পেশাটি স্বীকৃত পরিচিতি অর্জন করেছে।


বর্তমান সময়ে অনেক শিক্ষিত যুবক দক্ষ হাতে ক্যামেরা ধরেছেন। আর ক্যামেরার সূক্ষ লেন্সে তুলে আনছেন ভাবনা জাগানো গুরুত্বপূর্ণ ছবি। যাদের কল্যাণে সংবাদপত্রের পাতায় আমরা দেখি ভাব-সাগরে অবগাহন করার মতো হৃদয়স্পর্শী ছবি। শুধু তাই-ই নয়, ছন্দের বাজিখেলায় সাজিয়ে কবিতা লেখা কিংবা শব্দের রঙিন হোলি খেলা কোনো কোনো ফিচারলেখকও ভালো ছবি ধারণ করায় অগ্রসর হয়ে এসেছেন। কলমের পাশাপাশি ক্যামেরাও হাতে তুলে নিয়েছেন। অর্থাৎ এমনও দেখা গেছে যিনি ছবি তুলেছেন, তিনিই ফিচার লিখেছেন- এমন মেধাবী চিত্র-সাংবাদিক বিরল হলেও একেবারে দুষ্প্রাপ্য নয়।


মানসম্পন্ন ছবি ধারণ করা শুধু একটা ভালো পেশাদারিই নয়, বলা যেতে পারে নেশাও। যেমন কবিতা লেখা কবির একধরনের নেশা, তেমনই ভালো বিষয়ের ছবি তোলাও ফটো-সাংবাদিকের নেশা। আর যারা পেশা ও নেশাকে একসঙ্গে সমন্বিত করেছেন, জীবিকার পথ হিসেবে নিয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞা লব্ধ সতর্ক দৃষ্টি আরো সমৃদ্ধ করতে পারে ফটো-সাংবাদিকতাকে।


পাঠকপ্রিয় পত্রিকায় ফটো-সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ বিভাগকে অবহেলা করে কোনো দৈনিক প্রশ্নহীনভাবে পরিপূর্ণতা পায় না। চিন্তা জাগানিয়া ভালো ছবির সন্নিবেশ একটি পত্রিকাকে নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। এজন্য ভালো ফটো-জার্নালিস্টের পাশাপাশি থাকা চাই বিজ্ঞ ফটো-এডিটর। তা না হলে স্ষ্ঠুু সিদ্ধান্তের অভাবে একটি ভালো ছবি অপ্রকাশিত থেকে যেতে পারে? আবার তার বিপরীতে একটি মানহীন ছবিও ছাপা হয়ে যেতে পারে; যা পত্রিকার মানকে টেনে নিচে নামায়। এ কারণে ধারণকৃত ছবি নির্বাচনের পর্বে ভাববার অনেক বিষয় সামনে এসে দাঁড়ায়। একটি ভালো ছবি কিন্তু পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ছড়াতে পারে অদৃশ্য আবেদন, শানিত করতে পারে পাঠকের দৃষ্টির সীমানা। এসব ভেবে তবেই ছবি নির্বাচন।


আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, কোনো মহলকে খুশি করতে কিছু ছবি ছাপা হয় পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে; হতে পারে সেটা ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক কিংবা মালিকানার গুরুত্বে- যেটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতা ও দ্বিতীয় পাতায় কখনো কখনো ছাপা হয়, যেটাকে পাঠক ভ্রƒকুঁচকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে অবলোকন করে। এতে একটি মহল খুশি হলেও পাঠকের বৃহত্তর অংশ মন্দের বুলি আউড়িয়ে বিদ্রƒপাত্মক তির্যক দৃষ্টি মেলে ব্যঙ্গ করে। এতে পত্রিকার পক্ষপাতিত্বমূলক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়।


ব্যবসায়ী মহলের কিছু ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। ব্যবসা-বাণিজ্য পাতায় এ ছবি ছাপানো দূষণীয় নয় বরং আবশ্যকীয়। তবে এ ছবি যদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়ে পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে দৃশ্যমান জায়গায় স্থান করে নেয়, তাহলে তো পাঠক ভ্রƒ কুঁচকাবেই।


অনেক সংবাদপত্র মালিককে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বিধায় ছবি কাভারেজ দিতে দেখা যায়। আবার মানের প্রশ্নে আপসহীন এবং পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার সম্পর্কে অনেক পত্রিকা কখনই এমনটা করে না। ভাবতে হবে, সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশের গুরুত্বের বিষয়কে এটা কতটা নিচে নামায়। তাই সংবাদপত্রে ছবি ছাপার বিষয়ে ছবি-সম্পাদকের প্রভাব ও পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা থাকা দরকার। সতর্কতা অবলম্বনে একদিকে গুরুত্বপূর্ণ ছবি বাদ না পড়ে, অন্যদিকে অগুরুত্বপূর্ণ ছবি যেন না ছাপা হয়।
আরেকটি বিষয়, বোধের সংকটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবি সংবাদপত্রে ছাপানোই হয় না, পক্ষান্তরে অনেক গুরুত্বহীন ছবি ছাপা হয়ে যায়। এ বিষয়টিও সংবাদপত্রের মান কঠিনভাবে ক্ষুণ্ন করে। আর পাঠকের বিরক্তির সূচকে শেষমেষ এর দায় গিয়ে পড়ে পত্রিকার প্রচারসংখ্যার ওপর।


সংবাদপত্রজগতে ‘রাইট ম্যান রাইট প্রেস’ বলে একটা কথা আছে। এর পেছনের মর্মার্থ হচ্ছে- সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ দিয়ে কার্যসম্পাদন করানো। কারণ সঠিক পদে উপযুক্ত কর্মী যদি কর্ম-সম্পদনা না করে তাহলে পত্রিকার মান অনিবার্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য এবং সে পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা ও ব্যবসা-সফলতা পেতে বাধাগ্রস্ত হবে।
সংবাদপত্র এমনই একটি শিল্প যেটা গণমাধ্যমে জগতে সিনেমা, টেলিভিশন ও রেডিওর পরিচালনা ব্যবস্থা থেকে আরো সূক্ষ স্তরে অবস্থান করে। পত্রিকায় অনেক জাঁদরেল কর্মী নিয়োজিত থাকার পরও দেখা যায় পত্রিকা ব্যবসা-সফল ও পাঠকপ্রিয় হয়নি। অথচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পত্রিকার সম্পাদনা মান যথেষ্ট উন্নত। শুধু কৌশলগত কিছু কারণে পত্রিকার পরিচালনা ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের কালো ছায়া নেমে আসে। এজন্য দায়বদ্ধতা প্ল-ানিং বিভাগ বা পরিকল্পনা বিভাগের কাঁধে চাপে; যারা কি না যথাযথ দায়িত্ব পালনে সফল হয়নি। এমনও দেখা যায়, নতুন টেলিভিশনের চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে যতটা সহজে একটা মিডিয়া-ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু নতুন পত্রিকা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হলেই বহু অর্থ ব্যয়ে ততটা সহজে দাঁড়াতে সমর্থ হয় না। তার একটি মাত্র কারণ বাস্তবমুখী সুপরিকল্পনার ঘাটতি।


তাই বলা যায়, পরামর্শ পেলে একজন সাধারণ ফটো-সাংবাদিকও ভালো ছবি তুলে এনে দিতে পারেন। দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রয়োজনীয় পরামর্শের অংশীদারি পেলে বেশিরভাগ সাধারণ মাপের ফটো-কর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সমৃদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির ফটো-জার্নালিস্ট।


সংবাদপত্রকে সমৃদ্ধ ছবির অধিকারী করতে হলে একদিকে যেমন দরকার মানসম্পন্ন ছবি অন্যদিকে তেমন দরকার সম্পাদনায় সঠিক সিদ্ধান্ত। তাহলেই কেবল সংবাদপত্রের ফটো বিভাগ পেতে পারে সমৃদ্ধির সোপান।


লেখক: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিষয়ক লেখক।