আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে হয়েছে বিকশিত। জাতি আজ নিজস্ব চেতনার আলোকে বিশ^ দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তৈরি হয়েছে স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে পাঁচ পর্বে তুলে ধরা হচ্ছে সেই গৌরবগাথা। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব।
সংস্কৃতি ও ভাষা বিকশিত হওয়ার স্বার্থেই সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষা-দীক্ষার উৎকর্ষ সাধনে বিভিন্ন পরম্পরায় বিবিধ মনিষী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রগতিশীল ভাবনার সমন্বয়ে এবং বহু ঋদ্ধ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের প্রাজ্ঞতার স্পর্শে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বর্তমান রূপ লাভ করেছে। খন্ডিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলেও চর্যাপদের সময়কাল বিবেচনা করলে অন্তত হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একটা পটভূমিকা আমরা আমাদের মনস্তত্ত্বে সহজেই অনুভব করতে পারি। বাঙালি চেতনার জাতীয়তাবোধ ঠিক কখন থেকে বর্ণনা করার মত পর্যায়ে অনুভূত হয়েছে, তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা সীমায়িত করা অনুচিত হবে। বরং, তা ইতিহাসবিদ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক গবেষকদের দ্বারা নির্ধারিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে যে সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাবোধ, তা খোলা চোখে দৃশ্যমান হওয়ার পর সেই ইতিহাসের যাত্রাপথ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল বিবেচনায় নিলে খুব বেশি অপরিপক্কতার পরিচয় মিলবে না বোধ করি।
পূর্বকাল বিবেচনায় বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের পাশাপাশি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস থাকলেও ১৯৪৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারায় অনিবার্যভাবে বিভাজিত হলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর হীনম্মন্যতার চরম শিকারে পরিণত হয় বর্তমান বাংলাদেশের বাংলা ভাষা।
তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিপরীতে সুপরিকল্পিতভাবে বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িক মানসে ধর্মকে ব্যবহার করে এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠ্যচর্চাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা এমনকি বাংলা কে উর্দু অক্ষরে লিখবার ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে চিরতরে মুছে ফেলার সুদূরপ্রসারী নীল নকশা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। অপরদিকে বলে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীন ভারতের অংশভুক্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের ভাষা ব্যবহার এবং শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় অন্তত ন্যক্কারজনকভাবে এমনতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি।
হাজার বছর ধরে চলে আসা এ ভূখণ্ডের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে চিরতরে বাংলা ভাষাকে বিদায় করার প্রয়াস পেতেই বাঙালি জনগণের ভাষা কেন্দ্রিক আত্মতাগীদ জাগ্রত হয়ে সংগ্রামী ভাষা আন্দোলনে পরিণত হয়। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, বুলেট-বোমার মুখোমুখি হয়ে বেশ কয়েকজন ভাষা সৈনিকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালে এ বাঙালি জনগোষ্ঠী মাতৃভাষাকে রক্ষা করে পৃথিবীর বুকে বিরল ইতিহাস রচনা করেন। ভাষা রক্ষায় এমন পরিসরে রক্তদানের কীর্তি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাঙালির ইতিহাস ব্যতীত বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ অনুধাবনের লক্ষ্যে বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের সরল উপলব্ধি জন্মাতে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটের সামান্য আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। সাম্রাজ্যবাদিতার পরম্পরার কষাঘাতে সমগ্র ভারতবর্ষ এক ভারত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়নি কখনোই। সর্বশেষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থেকে নানা সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করা হলেও আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশকে পরাজিত করে ভারত রাষ্ট্র জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়নি। সমগ্র ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠী, তাদের ভাষা সংস্কৃতির ভিন্নতা, ভূ-সম্পদের পার্থক্য, এমনকী জনসংখ্যার ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্য, জাত-পাত, বর্ণ বিভেদ আর মোটাদাগে ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন পরিচয় শুরু থেকেই এক ভারত রাষ্ট্র গঠনের উপযোগী ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষার পার্থক্য সহ আর্য, অনার্য বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং সুপরিকল্পিত কূটনীতির প্রভাব একক ভারতের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। ফলে সে সময়ের উচ্চ মার্গীয় নেতৃবর্গ মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাস বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শের-ই- ব্ংলা একে ফজলুল হক সহ অনেকেই এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। কখনও উত্তরে আন্দোলন শুরু হলে দক্ষিণে সমর্থন পায়নি, আবার দক্ষিনে শুরু হলে উত্তর চুপচাপ ছিল কিংবা যখন বাংলায় শুরু হয়েছে সেখানে দিল্লি নিষ্ক্রিয় থেকেছে, না হয় উল্টো ব্রিটিশকে সহায়তা করেছে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে। এই রকম প্রেক্ষাপটে কার্যত গর্ব করবার মতো জাতীয়তাবাদের ল্যান্ডমার্ক হিসাবে একক জাতীয়তাবাদের কোন ভিত্তি রচনা করা সম্ভব হয়নি সমগ্র ভারতবর্ষে।
হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ফলে আবেগ অনুভূতির আদান প্রদান করতে করতে আপন মনোভাবসম্পন্ন আন্তরিক বন্ধন গড়ে তোলে। জাতিরাষ্ট্র তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট পূর্ব পর্যন্ত একই ভাষাভাষীর মানুষ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে একে অপরকে আপন আত্মীয় ভাবার ক্ষেত্রে যে টান বা মায়া অনুভব করতো, মূলত সেই অনুভূতির সচেতন বোধকেই জাতীয়তাবোধ বলা যেতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় এসে পূর্বপটের জাতীয়তাবাদের বিমূর্ত রূপটি মূর্ত হয়ে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কিংবা একটি জাতি রাষ্ট্রের জাতীয় চেতনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
১৯০০ থেকে শুরু থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টিকে ভাষা সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনার বিমূর্ততা উতরে মূর্ততার প্রাথমিক ও পরিপক্কতার স্পষ্ট রূপ লাভের সময় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বঙ্গভঙ্গ রোধ, ভাষা আন্দোলন ও নানান রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৬৬‘র ছয় দফা ৬৯‘র গণঅভ্যুত্থান, ৭০‘র নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী ৭১‘র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষ বাঙালি জাতি হিসেবে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয় চেতনাতকেই সর্বাগ্রে গ্রহণ করেছে।
ভারতবর্ষে বহুবিধ ভাষা, নানা ধর্ম-বর্ণ, জাতপাত গোত্র, নানা সংস্কৃতি, খন্ড খন্ড অঞ্চলিক ঐতিহ্য, নানান অঞ্চলের মানুষের নানান রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, আর্য-অনার্য ইত্যাদি নানা মতের কারণে শিক্ষাদীক্ষায়, সামাজিক বন্ধনে নানা প্রশাসনিক বৈষম্যের কারণে বিশেষ কোনো একক আদর্শে সবাইকে একমতে এনে স্বাধীন একক ভারত রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়নি বলে ব্রিটিশদের চলে যাবার প্রাক্কালে তদানীন্তন রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, নমনীয়তা ও তোষামোদের ফসল হিসেবে ব্রিটিশরা ধর্মভিত্তিক বিভাজন করে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন। বিশেষ আন্দোলনের ফসল না হওয়ায় এ কথা খুব পরিষ্কার যে, উভয় দেশই শুরুতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেই পৃথক হল। মুশকিলটা হল উভয় দেশেই তখনো নানা ধর্মের নানা মতের নানা সংস্কৃতির মানুষ রয়েই গেল। ফলে জন্মের মধ্যেই ভাঙনের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান থেকেই গেল। বিকল্প হিসেবে এক ভারতীয় অস্তিত্ব অনুভবে যার যার ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং অন্যান্য অনুসঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপুঞ্জ আকারে যাত্রা শুরু করতে পারতো, কিন্তু তৎকালীন নেতৃবর্গ সে পথে সফল চিন্তায় হাঁটতে সক্ষম হননি তা বলাই যায়।
বর্তমান বাংলাদেশ আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হলাম। সঙ্গত কারণে আমাদের জাতীয়তাবাদের পরিচয় হলো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এখানটা মুসলিম প্রধান হলেও উল্লেখযোগ্য সকল ধর্মের মানুষই বাস করে আসছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাংশের পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের লোক সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যার চেয়ে অধিক ছিল। এই অংশের উৎপাদন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় উন্নত ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হতো।
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে অন্তত ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় বিধান আলোচনা সাপেক্ষে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বন্টন, চাকরি-বাকরির সুযোগ সুবিধা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শিক্ষাদিক্ষা, কলকারখানার সমতাভিত্তিক বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার এমনটাই রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে মানদণ্ড হিসেবে কার্যকরী হবে সেটা সকলেই আশা করেছিল। কিন্তু বিধি বাম ! অধার্মিকের কাছে ধর্ম নিরাপদ নয়। [চলবে]
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL