আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নানা পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে হয়েছে বিকশিত। জাতি আজ নিজস্ব চেতনার আলোকে বিশ^ দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে আছে। তৈরি হয়েছে স্বতন্ত্র পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে পাঁচ পর্বে তুলে ধরা হলো সেই গৌরবগাথা। আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব
ভাগ্যের পরিহাস ‘খায় দায় কছিমুদ্দিন, মোটা হয় জব্বার’। ৭৫ পরবর্তী জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ শাসনের মধ্য দিয়ে বাঙালির নাগরিকচিত্তে যে পচন ধরেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ৯১ নির্বাচনে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবন বাজি রেখে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই আন্দোলনের ফসল আওয়ামী লীগের ঘরে না এসে চলে যায় বিএনপির ঘরে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নতুন নতুন মাত্রা প্রকাশিত হতে থাকে। বিএনপি জামায়াতের সখ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে চোখে পড়ার মতো। যেন কেউ ছাড়া কেউ নয়।
কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংস্কৃতি অবরুদ্ধ হতে থাকলে লোক দেখানো কিছু উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পন্ন করা গেলেও গণতন্ত্রের চর্চা করা সম্ভব নয়। কেননা সাম্প্রদায়িক চেতনায় ভর করে কেবলই নতুন মাত্রার স্বৈরশাসন কিংবা সাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব প্রদান করে বহালতবিয়তে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এনে জামাতি ইসলামের রাজনীতিকেই চাঙ্গা করতে থাকলেন। পরামর্শকদের ভুল পরামর্শ গ্রহণ করে বুঝে কিংবা না বুঝে তিনি খাল কেটেই কুমির আনলেন। ক্ষমতার উচ্চাভিলাসের পরিবর্তে রাজনীতিকেই তিনি যদি উত্তম আদর্শ হিসেবে বেছে নিতে পারতেন, তাহলে মধ্য ডানপন্থী অবস্থানকে ক্ষমতা এবং রাজনীতির সংমিশ্রণে জামাতকে সাইড লাইনে রেখেই নিজের দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেক বেশি সুসংগঠিত করবার সুযোগ ছিল সে সময়ের সার্বিক প্রেক্ষাপটে। মূলত সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের কৃষ্ণগহবরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবেশকে তিনি অবলীলায় উৎসাহিত করতে থাকলেন। জামায়াত-বিএনপি হয়ে যাবে এমন ধারণা পরামর্শকগণ তাকে দিয়ে থাকলেও কোন সুপরামর্শক তাকে এমন কোন সুপরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা যে এ প্রক্রিয়ায় বিএনপি পর্যায়ক্রমে জামাতে পরিণত হবে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। এ বক্তব্যের যথার্থতা স্পষ্ট হবে দ্বিতীয়বার তার ক্ষমতা গ্রহন উত্তর কার্যকলাপের বিশ্লেষণে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুনে প্রবল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮ এ জয়লাভ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় এলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম প্রহর কেটে যায় দেশকে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী অপশাসনের কলুষতা থেকে মুক্ত করতে। সমাজের সকল স্তরে চলমান মানসিক দৈন্যতা, দেশীয় সম্পদের অপব্যবহার, অর্থ পাচার, অপশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থেকে একটু একটু করে দেশটাকে পুনরায় গুছিয়ে নিতে যত্নবান হয় আওয়ামী লীগ সরকার।
ধীরে ধীরে স্বমহিমায় ফিরতে থাকে বাংলাদেশ। সাধারণ জনতা পুনরায় সেই আস্থা ফিরে পায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে বর্হিদেশীয় আন্তঃর্জাতিক সম্পর্কের ধারাবাহিক উন্নয়নের দ্বারা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। জনগণের আস্থালাভের ফলস্বরূপ ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপরিচালনা করে চলেছে। অর্থ বাণিজ্য, উৎপাদন, চিকিৎসা, মানবাধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি সকল খাতেই একটি দৃশ্যমান উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে, এই কথা বলাই বাহুল্য। মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী নরপশুদের বিচার চলমান ধারায় অক্ষুণ্ণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রেহাই পায়নি। সগৌরবে স্থাপিত হয়েছে রামপাল পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষিখাতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎপাদন বেড়েছে। কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। আজ স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু।
উন্নয়নের কথা বলতে গেলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাপ্তির শেষ নেই। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে শুধুমাত্র এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি সুপ্রাচীন জনপদের জাতীয়তাবোধ সুরক্ষার জন্য যথেষ্ঠ নয়। এই সব উন্নয়নের সমান্তরালে যদি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের মূল তত্ত্ব বঙ্গবন্ধুর সেই সংস্কৃতিনির্ভর অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেত, তাহলে আজ এভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পরার আতঙ্ক অনুভব হতো না। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাঙ্গার স্পর্ধা দেখায়। পৃক্ষাগৃহে বোমা বিস্ফোরণ হয়, রমনার বটমূলে গ্রেনেড হামলা হয়, প্রকাশ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। বাঙালির আবহমানকালের উৎসব নববর্ষবরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ধৃষ্টতা দেখায় তারা। তাদের এই দুঃসাহসের পিছনে আভ্যন্তরীন মদতদাতারা যেমন আছে, তেমনি বিদেশী সুযোগসন্ধানী কূটনীতির প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। বলা বাহুল্য, বিগত সময়ে দেশে যে পরিমান মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছে, সেই অনুপাতে এক শতাংশও সাংস্কৃতিক কর্মশালার আয়োজন করা হয় নি। এই চরম রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা দেশের মূল জাতীয়তাবাদের ধারাকে ক্ষীণকায় করতে করতে আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার সামগ্রিক ইতিহাসের সার্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে চিত্রটি ফুঁটে ওঠে, তার কিছু কিছু অংশ যেমন আলোকিত রৌদ্রজ্জ্বল, তেমনি ঈশান কোনে কালো মেঘের ঘনঘটাও ততটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে সেই স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তিগুলো বিগত সময়ে আরো বেশী সংঘবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিদেশী কূটনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকারের মদতেই তারা আজ এতটা শক্তিশালী। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বারবার সেই সব বিদেশী প্রভুদের দারস্থ হওয়াটাকে জাতীয় চর্চায় পরিণত করতে দ্বিধা বোধ করেন নি ক্ষমতার প্রলোভনে। অথচ, সুনিপুণ ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নিজস্ব স্বার্থ ছাড়া কেউই কখনো উদারচিত্তে বাংলাদেশের মত ছোট কিন্তু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। প্রাচ্যের দেশগুলো বরাবরই আমাদের বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং বলতে দ্বিধা নেই, সেই সুযোগ বারবার আমরাই তাদের করে দিয়েছি। ব্রিটিশ ও আমেরিকা গনতন্ত্রের কথা ভেবে কোনো দেশকে সুশাসনের পথে নিয়ে এসেছে এমন উদাহরণ বোধ করি কোনো উন্মাদও দেখাতে পারবেনা। অথচ,বারবার নির্বাচনের মত একটি অন্যতম প্রধান আভ্যন্তরীন জাতীয়তাবাদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে তাদেরকেই আমাদের দন্ডমুন্ডের প্রভু বানিয়ে রাখি, যারা কি না আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি শত্রপক্ষকে সমর্থন ও সাহায্য করেছিল।
এদিকে তাদেরই সামরিক আগ্রাসনে একের পর এক কত দেশ চোখের সামনে ধ্বংস হয়েছে সাম্প্রতিক সময়েও। রাজনীতির নামে এই সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের খেলায় মেতে আমাদের মধ্যে অনেকেই বুঝেসুজেই আজ নিজেদের অস্তিত্বকেই বিসর্জন দিতে উদগ্রীব হয়ে আছি।
অবিলম্বে বন্ধ হোক এই আত্মঘাতী প্রহসন। দেশের সবচেয়ে বড় চেতনার জায়গায়, সবচেয়ে বড় গৌরবের স্তম্ভে আঘাত করে ক্ষমতায় গিয়ে কি হবে? দাবানলের দহন থেকে তৃণলতাও কিন্তু রেহাই পায় না। দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বহমানতাকে অক্ষুন্ন রেখে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সংস্কৃতিপ্রধান জাতীয়তাবাদই বাংলাদেশের স্থায়িত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। মৌলবাদী অপশক্তিকে পরিহার করে দেশের অস্তিত্বরক্ষার আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষকে এখনই একতাবদ্ধ না করতে পারলে অচিরেই হয়তো সেই পশ্চিমা পরাশক্তির কাছে মাথা নত করে তাদের সরাসরি দাসত্ব স্বীকার করেই টিকে থাকতে হবে আমাদের। সেই দিন কিন্তু সরকার বা বিরোধী দল সকলেই প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন ক্লীব হয়েই থাকতে হবে। হাজার বছরের বাঙালি সভ্যতার অস্তিত্বরক্ষার এই দায় একক ভাবে কোনো সরকারের নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতির। তাই সেই ৫২-র মতো, ৭১-এর মতো আমাদের আবার একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনায় একতাবদ্ধ হতে হবে। নিঃসন্দেহে সেই চেতনা হতে হবে আবহমান কালের বাঙালি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাধারণ মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার আদর্শে অনুপ্রাণিত বঙ্গবন্ধুর সেই আলোকিত পথের চেতনা। তাই এবারের সংগ্রাম হোক প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম হোক চিরস্থায়ী সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম। [শেষ]
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL