২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
কলাম

বিদেশি চ্যানেলে বিমুগ্ধ দর্শক

দিন পরিবর্তন ডেস্ক

প্রকাশিতঃ ২০২৩-১২-১৯ ১৯:১৬:৫০
...

দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন-দর্শক মনে বাসা বেঁধেছে। অনুষ্ঠান নির্মাতারা দশকদের সন্তোষ্টি ধরে রাখতে পারছে না। ফলে বিমুখ হয়ে দর্শকদের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে বিদেশি চ্যানেলে।

দর্শক টেলিভিশনের রিমোর্ট টিপে বহু দূরের বিদেশি চ্যানেল একবারে সম্মুখে পায় স্যাটেলাইটের কল্যাণে। চ্যানেলগুলোর প্রচারিত বহুবিচিত্র অনুষ্ঠানে মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা সময়ের স্রোতে গা-ভাসায়। তাই দিনেদিনে বিদেশি চ্যানেলগুলো হয়ে গেছে ড্রয়িংরুমের বিনোদনকেন্দ্র।
দূরকে কাছে আনে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিনির্ভর চ্যানেলগুলোকে পণ্য প্রচারে ব্যবহার করছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বহু শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের প্রসার ঘটাতে যেকোনো শিল্পমালিক সর্বোচ্চ প্রচারকে গুরুত্ব দেবেন- এটাই স্বাভাবিক। তার উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত প্রচার যদি না ঘটে তাহলে তো কোম্পানির লক্ষ্য পূরণ হবে না। একসময় একটা প্রশ্ন উঠেছিল বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়া নিয়ে। যেসব কোম্পানির পণ্য স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি বাজারে স্থান করে নিয়েছে, তাদের প্রচার তো শুধু দেশি চ্যানেল দিয়ে পুরোপুরি সম্ভব নয়। তাদের পণ্যের ক্ষেত্র যেমন বিস্তৃত তেমন প্রচারও ব্যাপক পরিসরে হওয়া চাই।

অনেক আগে প্রকাশিত একটি দৈনিকের সূত্রমতে, বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ছিল ৪১টি, তবে সম্প্রচারে ৩২টির কথা বলা হয়। এবং অন্য এক জরিপের মতে, মোট দর্শকের ৮০ শতাংশই ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখেন।
ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসা, জি-বাংলা, জি-সিনেমা, জলসা মুভিজ, কালার্স বাংলা এরমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গেছে দর্শকমহলে। এসব চ্যানেল আজ বাংলার গ্রাম-শহর-বন্দরে চিত্তবিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ। এই চ্যানেলগুলোর কিছু দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান আছে। এখানে তা উল্লেখ না করলেই নয়।
অনেক আগে স্টার জলসায় প্রচার হতো- চোখের তারা তুই, বোঝে না সে বোঝে না, ইষ্টিকুটুম, তোমায় আমায় মিলে। এরপর প্রচার হয়- পটল কুমার গানওয়ালা, কুসুম দোলা, কে আপন কে পর, মিলন তিথি, পুণ্যিপুকুর, রাখিবন্ধন, বধূবরণ।
জি-বাংলায় অনেক আগে প্রচার হতো- রাশি, গোয়েন্দা গিন্নি, রাধা, জড়োয়ার ঝুমকো, ভুতু, আমার দুর্গা, এই ছেলেটা ভেলভেলেটা, পিলু, ত্রিনয়নী, রাঙ্গা বউ, মিঠাই ; বর্তমানে প্রচার হচ্ছে- দিদি নাম্বার ওয়ান, দাদাগিরি, জগদ্ধাত্রী, ফুলকি, নিম ফুলের মধু, কোন গোপনে মন ভেসেছে, মিলি, মিঠিঝোরা, মন দিতে চাই, শ্রী কৃষ্ণ লীলা, আলোরকোলে।
ভারতীয় চ্যানেল ইন্টারটেন বাংলা, সান বাংলা উত্তরবঙ্গের গ্রাম্য এলাকার দর্শকরা বেশি দেখে। মন সুন্দর, প্রেম বন্ধন, নাগমনি, ক্রাইম অ্যালার্ট ধারাবাহিকগুলো দর্শকদের বেশি প্রিয়।

এসব ধারাবাহিকে দর্শক এত আসক্ত যে, আগামী পর্বে কী প্রচার হবে তা দেখার প্রস্তুতিতে প্রহর গোনেন। রাত-দিন এখন বাংলাদেশি দর্শকরা বিদেশি চ্যানেলে বিনোদন খোঁজেন।

এত গেল বাংলা চ্যানেলের কথা। এবার ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের কথায় আসা যাক। সনি টিভি, সনি ম্যাক্স, স্টার প্লাস, জি-টিভি, কালার্স হিন্দি, জি সিনেমা, স্টার গোল্ড বাংলাদেশি দর্শকদের কাছে আরো খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে। আগে সনিতে প্রচার হতো- ইতনা করো না বুঝে পিয়ার, এক দুজে কি ওয়াস্তে; এই ধারাবাহিক দুটি গভীর প্রেমের এত বড় উদাহরণ যে, এর তুলনা সমসাময়িক নাটকে পাওয়া দুষ্কর।
ইতনা করো না বুঝে পিয়ার-এ নীল ও রাগিনী দুটি চরিত্র মধ্যবয়সী প্রেমের এবং এক দুজে কি ওয়াস্তে সমু ও শ্রাবণ চরিত্রে কিশোর প্রেমের অনন্য প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে; এদের অভিনয় চরিত্রগুলো এত গভীর ছিল যে, অনেক দর্শককে নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলোর অনুভূতির বাঁকে বাঁকে নিয়ে যায়; যা চলতি সময়ের কোনো সিরিজের সঙ্গে মেলে না। শুধু তাই নয়, সনি টিভির ক্রাইম পেট্রল, সিআইডি সিরিজ দর্শক মনের টানে উপভোগ করে। সনি টিভির কাপিল সরমা শো ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে সনিতে প্রচার হচ্ছে কাবিয়া, বার্সাতে, দাবাঙ্গি, কন বানেগা ক্রোড়পতি বাংলাদেশি দর্শকদের বেশি টানে।পারিনিত, শিবশক্তি, নিরজা, ডরি, চাঁদ জ¦লনে লাগা, বিগ বস দর্শকদের প্রিয় অনুষ্ঠান।
ভারতীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে পরিবারে মনোমালিন্য এবং রিমোর্ট কাড়াকাড়ি পর্যন্ত হয়। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর। এখানে দুটি পারিবারিক খণ্ড ঘটনা না বলে পারছি না। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বেশ মেধাবী। বার্ষিক খেলায় সমবয়সীদের হারিয়ে দু-তিনটা প্রাইজ জিতে এবং বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। এই আদুরে শিশু তার প্রিয় বিদেশি চ্যানেল দেখার জন্য বড়দের কাছ থেকে রিমোর্ট কেড়ে নেয়। কখনো না পেলে ঝগড়া বাধিয়ে কান্না শুরু করে। এত গেল এক শিশুর আসক্তির কথা, এবার ঘরের কথা একটু বলি- অফিসের কাজ সেরে যখন রাত ১০টায় বাসায় ফিরি তখন দেখি আমার কাছের মানুষটি রিমোর্ট হাতে টিভি স্ক্রিনে ব্যস্ত। সেটা অবশ্যই বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান নিয়ে। বিরক্ত হয়ে শিক্ষণীয় কিছু বললে, শোনা যায় নিত্যদিনের চেনা শব্দ ও দেখা যায় তৃপ্তির হাসি।
এটা কেবল একটি পরিবারের একক ঘটনা নয়। এটা হচ্ছে একটি সামাজিক প্রতিচ্ছবি। হয়তো এর চেয়ে আরো গভীর ঘটনা সমাজে আছে। বিদেশি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান দেখা, না-দেখা নিয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও সংবাদপত্রে দেখা গেছে। এখন আমাদের ভাবার সময় এসেছে, কেন এমন ঘটছে। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ মানের কারণে কি বিদেশি টিভির প্রতি আসক্তি?

আশির দশকে আমাদের দেশে এত বিদেশি চ্যানেলও ছিল না, আসক্তিও ছিল না। তখন দেশি ধারাবাহিকগুলো ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে- এসব দিনরাত্রি, অয়ময়, সংসপ্তক ধারাবাহিক নাটকগুলো দর্শকরা উপভোগ করত আনন্দের সঙ্গে। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর একটি নাটকে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নাটকের ধারাবাহিকতায় তার ফাঁসির আশঙ্কায় ভক্ত দর্শকরা রাস্তায় স্লোগান তুলে মিছিল করেছিলেন- ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, ভাঙব টিভি ঘরে ঘরে’। একটি টিভি নাটকে হুমায়ূন ফরীদি অভিনয় করেছিলেন কানকাটা রমজান চরিত্রে। এসব চরিত্র ছিল তখন খুবই জনপ্রিয়। ‘ছিঃ ছিঃ তুমি এত খারাপ’ এ রকম ডায়ালগ রাস্তাঘাটে শোনা গেছে তখন। তখন তো আমরা টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণে সার্থক ছিলাম। এখন কেন দর্শক হারাচ্ছি? এ প্রশ্ন অনেকের।

এক সময় বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের কিছু শিল্পী-কলাকৌশলীদের আন্দোলন করতে দেখা গেছে। তাদের দাবি, বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে। কারণ ভারতীয় চ্যানেল চালু হওয়ায় বাংলাদেশের দর্শকরা তাদের দেশীয় চ্যানেল দেখছেন না। এতে দেশি চ্যানেলগুলোর সামগ্রিক ক্ষতি হচ্ছে।
ভারতীয় যে কয়টি চ্যানেল বাংলাদেশে জনপ্রিয় তাদের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, অভিনয় শিল্পীদের চেহারা, পোশাক, শেড, সংলাপ, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিনয় দক্ষতা সর্বোপরি থিম- সবকিছুই উপযুক্ত মানসম্পন্ন। বলা যায়, এসব কারণে আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো পিছিয়ে গেছে প্রতিযোগিতায়। এরফলে দর্শকের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিজ্ঞাপনদাতাকেও ঝুঁকতে দেখা গেছে বিদেশি চ্যানেলে। আকাশ সংস্কৃতির যুগে সবাই হাতের কাছের ভালোটাই গ্রহণ করবে। এখন আমাদের মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের ভাবতে হবে আমরা কী করবো।

২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন পাস হয়। ওই আইনের ১৯(১৩) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। ওই ধারার লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। ওই আইনের ১৫ ধারা অনুসারে কোনো অনুষ্ঠান ১৯ ধারার পরিপন্থি হলে সরকার তাৎক্ষণিক বা যাচাই করে বিপণন, প্রজ্ঞাপন ও সম্প্রচার সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধের নির্দেশ দিতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার তো শুধু বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য নয়, বিদেশে যে এলাকাব্যাপী ওই চ্যানেলের প্রচার কার্যক্রম রয়েছে সেখানে রয়েছে আমাদের দেশি পণ্যের প্রসারিত বাজার। সেসব এলাকায় রীতিমতো আমাদের পণ্য ওই দেশীয় অনেক পণ্যের ভিড়ে বাজার দখল করে আছে। ওই দেশীয় একই ধরনের পণের একই চ্যানেলে বিজ্ঞাপন গেলে এবং আমাদের বিজ্ঞাপন প্রচার না হলে রপ্তানি পণ্য মার খেতে পারে। এটাও সরকারকে ভাবতে হবে।

চ্যানেল মালিক ও শিল্পীদের ভাবতে হবে আমাদের অসংগতিগুলো কোথায়? সেগুলো আগে দূর করতে হবে, দেশি চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। আর সরকারেরও উচিত সেই বিষয়গুলো তদন্ত করে একটি বিধিমালার অধীনে আনা।
যেদেশে আমাদের চ্যানেলগুলো সম্প্রচার পায় না, ওই দেশের চ্যানেল আমাদের দেশে সম্প্রচার পাবে কেন? এসব অসঙ্গতি নিয়েও সরকারকে ভাবতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক